Friday, June 24, 2016

"দুধ কলা, কাল সাপ আর আদর্শ ছেলে ফাহিম"

বিদেশে যাচ্ছে - বাবা মাকে একথা জানিয়ে বাড়ি ছেড়েছিল ফাহিম। তারপর মাদারীপুরে গিয়ে এক শিক্ষককে হত্যার উদ্দেশ্যে কুপিয়ে জখম করেছে সে, দুই সঙ্গীসহ। কারণ ঐ শিক্ষক হিন্দু, মুসলিম নন। ফাহিম যে ভিতরে ভিতরে এরকম উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকেছে এ কথা তার পরিবার, বন্ধু, সহপাঠী বা শিক্ষক- কেউ জানতো না। এসএসসি তে জিপিএ-৫ পাওয়া ছেলে। এইচএসসিতেও ভালো করার কথা ছিল। সবসময় পরীক্ষা আর ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিতি। কারো সাতে পাঁচে নাই। পাঁচবার মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করছে। এহেন ছেলেকে সবাই সন্দেহের বাইরে রাখবে তো বটেই, তাকে নিয়ে কেউ আসলে কখনো মাথাই ঘামাবে না। সে না বলে চলে যাওয়ায় বাবা মা পুলিশকে জানিয়েছে। 


ফাহিম

প্রতিবেশিরা বলেছে, এই ফাহিম কারো দিকে কখনও চোখ তুলে তাকাতো না। শুধু পড়ালেখা আর নামাজ কালাম নিয়েই থাকতো। এইখানে এসে আটকে গেলাম। কেন? একটা ১৭/১৮ বছর বয়সের ছেলে- সে কেন চোখ তুলে চায় না? তার তো দুই চোখ ভরে এই দুনিয়া দেখার কথা! তার তো চারিপাশ নিয়ে তীব্র কৌতূহল থাকার কথা। তার তো ক্রিকেট ফুটবল হলিউড বলিউড ফ্যাশন টিভি আড্ডা বন্ধু ফুচকা চটপটি আর গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ভাবার কথা, মেতে থাকার কথা। তবে কেন সে মুখ তুলে চাইতো না? কেন তার জীবন ঘর আর কলেজ আর মসজিদে সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল? কে করলো তাকে এমন? যে বাবা মা আজ সন্তানের ছবি পত্রিকার পাতায় দেখে আঁতকে উঠেছেন, আমি দিব্যি বলে দিতে পারি, এতোদিন তারা নিজের মুখচোরা অস্বাভাবিক ছেলেকে নিয়ে অত্যন্ত সুখি ছিলেন। কেন সুখি? ছেলে জিপিএ ৫ পায়, ছেলের কোন বন্ধু নাই, ছেলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, ছেলে ঘরেই থাকে- শুধু কলেজ আর মসজিদে যায়। এইসব অস্বাভাবিকত্ব নিয়ে ওই ব্যর্থ বাপ মা ছিলেন আত্মতৃপ্তিতে ভরপুর। তারা চাপা গর্ব নিয়ে ছেলেকে দেখতেন। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ছেলে এক অস্বাভাবিক জীবনবোধ নিয়ে বেড়ে উঠেছে, এক বীভৎস দর্শন কখন তাকে ভর করেছে- এসব কিছুই তারা জানতে আর বুঝতে পারেননি। 


শিক্ষক রিপন চক্রবর্তী

শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীর কোন শত্রু ছিল না। তিনি নিজের মত থাকতেন। হিন্দুধর্মের মানুষ বলেই তাকে এরকম একটি হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে হয়েছে। ফাহিম বা তার সঙ্গীদের কারো সাথেই তার কোন জানাশোনা ছিল না। উগ্রপন্থীদের বিশাল পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ফাহিমরা এই হামলায় অংশ নিয়েছিল নিশ্চয়ই। আগে শুনতাম, গরীব ঘরের ছেলেমেয়েদের কাজে লাগানো হয়। আজকাল পাশা উল্টে গেছে। অবস্থাপন্ন, শিক্ষিত বাপ মায়ের ছেলেমেয়েকে দলে ভিড়ানো হচ্ছে। এদিকে, শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশিদ টুটুল হত্যাচেষ্টা মামলায় আটক আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য সুমন হোসেন পাটোয়ারি জঙ্গি সংগঠনটি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। সুমনও নিতান্তই অল্পবয়সী একটা ছেলে। সে নিজেই টুটুলকে চাপাতি দিয়ে তিনটি কোপ দিয়েছে বলে স্বীকার করেছে। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় পাশেই এক মসজিদে গিয়ে রক্তমাখা চাপাতি ধুয়েছে। সুমন, ফাহিম- এই ছেলেগুলোর চেহারা খুবি সাধারণ। এদের দাড়ি নেই, পরনে পাঞ্জাবি নেই যে তাদের আপনি চট করে জঙ্গি বলে সনাক্ত করবেন। এরা কারো সাতে পাঁচে থাকে না বলেই আপাতদৃষ্টে মনে হয়। কিন্তু ভিতরে ভিতরে এদের মগজ ভরে গেছে হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা আর ক্লেদে। এরা এই পৃথিবীটাকে আপন করতে পারেনি। তাদেরকে পরকালের স্বপ্ন দেখিয়ে ইহকালকে বিষিয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। তারপর এরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে ছুটে গেছে তাদের দিকে, যাদের ওরা মনে করছে নাস্তিক, মুরতাদ, ইসলাম অবমাননাকারী। উগ্রগোষ্ঠীর পছন্দ অনুযায়ী জীবন বিধানের বাইরে চলছে যারা, তাদেরকে সরিয়ে দেয়াটাই এরা নিজের জীবনের মূল কাজ বলে ঠিক করে নিয়েছে। এরা শেখেনি মানুষকে ভালোবাসতে, এরা শেখেনি সহমর্মিতা, এরা জানেনা অভিযোজন কী। এদের কানে ক্রমাগত ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ হিংসা আর অশান্তির মন্ত্র আর ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা। এই প্রক্রিয়া তো একদিনের নয়। এটা বছরের পর বছর ধরে চলেছে। একদিনে ফাহিমকে প্রস্তুত করা সম্ভব নয়। কারণ কয়েকদিন বা কয়েক মাস কানে কুমন্ত্রণা দিলেই যেকোনো মানুষের পক্ষে চাপাতি হাতে ছুটে গিয়ে নিরপরাধ মানুষকে কুপিয়ে আসা সম্ভব না। এর জন্য দীর্ঘকাল ধরে মন্ত্রণা দিতে হয়, প্রশিক্ষণও লাগে। এইসব ঘটে গেল চোখের সামনে, আর বাপ মা খুশিতে বগল বাজালেন এই ভেবে, ছেলে জিপিএ পায়, ছেলে কারো পানে চোখ তুলে নাহি চায়! হায়রে! এই হলো এদেশে বেশিরভাগ মানুষের কাছে নৈতিকতার ব্যাখ্যা। 


ব্লগার অভিজিৎ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

ব্লগার হত্যাকাণ্ডে ধরা পড়া তরুণ জঙ্গিরা স্বীকারোক্তি দিয়েছে, চাপাতি দিয়ে হত্যায় সওয়াব বেশি, গুলিতে সওয়াব কম। সেইসব জঙ্গিদের কারো বয়স ২৫ থেকে ৩০ এর বেশি না। দেশকে গড়ে তোলার বয়সে দেশকে রক্তাক্ত করার মিশন নিয়ে নেমেছে তারা। পত্রিকায় পড়লাম, সদস্য সংগ্রহে পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত যুবকদের দলে টানছে আইএস। এর মধ্যে বিত্তশালী পরিবারের অনেক যুবকও আছে। তারা এখন সাইবার পরিচালনা, হাসপাতাল ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চালাতে সক্ষম যুবকদের ভেড়াচ্ছে। প্রায় ৭০০ তরুণ-তরুণী পাকিস্তান থেকে আইএসে যোগ দিয়েছে। 


ফাহিমের পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা বলেছেন, পত্রিকায় ছবি দেখে তিনি ফাহিমকে চিনতে পারেননি। তার ভাবনাতেও ছিল না যে তার পাশের বাড়িতেই কোন উগ্রপন্থী বাস করতে পারেন। তো তিনি বুঝবেন কী? নিজের ঘরের ভিতরে ছোটকাল থেকে উগ্রপন্থী পেলে পুষে বড় করেছেন বাপ মা, প্রতিবেশি তো কোন ছাড়! এই ঘটনার পর পাশের বাড়ির যে বাচ্চা ছেলেটাকে চোখের সামনে তরুণ হতে দেখলাম, তাকে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করেছি। সামনের বাড়িতে ভাড়া আসলেন যে ভদ্রলোক, তার মেহেদি দেয়া দাড়ি দেখে মনে মনে কেঁপে উঠেছি। জানি না, কে কোথায় ঘাপটি মেরে আছে। 


প্রকাশক ফইজল আরফিন দীপনকে
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে

আজ দেশের এই চরম ক্রান্তিকালে হা করে বসে আছি- বিচার করবে সরকার, অপরাধী ধরবে পুলিশ, শাস্তি দেবে সর্বোচ্চ। কিন্তু নিজের ঘরে কালসাপ দুধ কলা খেয়ে মোটা তাজা হচ্ছে কী না, তাই জানি না। কারণ সাপ রাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়, আমি ভাবি, সে আমার আপন। নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব কি শুধু ভোট দেয়া আর সরকারকে শাপশাপান্ত করা? নাকি, আমারও জানতে হবে, বুঝতে হবে, শিক্ষিত হতে হবে! নিজের জাতীয়তাবোধ আর অসাম্প্রদায়িক চেতনাটা শানিয়ে নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে আমাকেও। যে সন্তান আমার গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, সে এই সুন্দর দুনিয়াকে যদি কলুষিত করে, তার দায় তো আমারও। এই দায় তো এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নেই। নাকি আমি নিজেই জানি না দেশাত্মবোধ আর জাতীয়তাবোধের আসল সংজ্ঞা! নাকি নিজেই বুঝিনা মানুষ হওয়া কাকে বলে! যদি তাই হয়, তবে নিশ্চিত, আজ সামনে ঘোর অমানিশা! এর থেকে নিস্তার নেই! কেন এত অস্থির আমরা? কেন এত হিংস্র আর অসহিষ্ণু? কেন আমরা চাই নিজের মত একটা পৃথিবী? কেন আর কারো পছন্দ অপছন্দের ধার ধারি না?


একজন বাংলাদেশের হিন্দু ভাইয়ের চোখে ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদ, 
তার সুরক্ষার কারণে নাম প্রকাশ করা হল না